ঢাকা, ২৯ মে ২০২২ (রবিবার)ঃ দীর্ঘ ৩৪ বছরের পথ পরিক্রমায় বাংলাদেশ আজ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ। ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে যাত্রা শুরুর পর থেকে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা অত্যন্ত সফলতা ও পেশাদারিত্বের সাথে শান্তিরক্ষী মিশনে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের গর্বিত শান্তিরক্ষীরা বিশ্বের ৪০ টি দেশে ৫৫ টি মিশন সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে মোট ০৯টি দেশে সর্বমোট ১০টি মিশনে ৫৪৪৩ জন সেনাসদস্য নিয়োজিত আছেন (অন্যান্য বাহিনীসহ ৬৮২৫ জন)। এই মহান দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সর্বমোট ১২৬ জন নিহত এবং ২২৮ জন সদস্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের এই আত্মত্যাগ ও বীরত্বের কথা বিশ্ব শান্তিরক্ষার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী দিবস পালনের অংশ হিসেবে সকালে বাংলাদেশে সফররত ইউনাইটেড নেশনস ডিপার্টমেন্ট অব পিস অপারেশন এর সামরিক উপদেষ্টা ও সহকারি মহাসচিব জেনারেল বিরামে ডিওপ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর জিওসি-ইন-সি, ইস্টার্ন কমান্ড লেফটেন্যান্ট জেনারেল রানা প্রতাপ কলিতা, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ, এসবিপি, ওএসপি, এনডিইউ, পিএসসি, পিএইচডি এর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এছাড়াও তাঁরা গতকাল (২৮ মে ২০২২) ঢাকা সেনানিবাসস্থ শিখা অনির্বাণে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শাহাদৎবরণকারী বীর শহিদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
দিনটি পালনের অংশ হিসেবে আজ (২৯ মে ২০২২) সকালে তেঁজগাও পুরাতন বিমানবন্দরে একটি শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। এছাড়াও ঢাকাসহ অন্যান্য সকল সেনানিবাসে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের বিভিন্ন কার্যক্রমের উপর নির্মিত বিশেষ প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন এবং সিলেট ও রংপুর সেনানিবাসে শোভাযাত্রা ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী দিবস-২০২২ উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) সংবর্ধনা ও স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও টেলি কনফারেন্সিং (ভিটিসি) এর মাধ্যমে উপস্থিত থেকে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেন। এসময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক, তিন বাহিনীর সম্মানিত প্রধানগণ, পুলিশের মহাপরিদর্শক, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার, বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের রেসিডেন্ট কো-অর্ডিনেটর এমএস গাইন লুইস (MS Gwyn Lewis); জাতিসংঘের সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল বিরামে ডিওপ (Birame Diop) এবং মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব এ্যাডমিরাল খুরশীদ (অবঃ)। এই অনুষ্ঠানে সম্মানিত সংসদ সদস্য, বিভিন্ন বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ও সামরিক উপদেষ্টা, সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাগণ, ভারতের জিওসি-ইন-সি, ইস্টার্ন কমান্ড, বুদ্ধিজীবি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, শান্তিরক্ষী, সাংবাদিকগণ এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
বিকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ঢাকা সেনানিবাসস্থ আর্মি মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্সে ‘শান্তিরক্ষা অপারেশনের বিবর্তনের মডেলঃ সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রয়োজনীয় রূপান্তরের রূপরেখা’ শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করা হয়। সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিক, আরসিডিএস, পিএসসি (অবঃ)। এছাড়াও সেমিনারে তিন বাহিনী প্রধানগণ, সাবেক সেনাপ্রধানবৃন্দ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মাননীয় সদস্যগণ, সশস্ত্র বাহিনী ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিববৃন্দ, বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিগণ, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নিরাপত্তা বিশ্লেষক, শিক্ষাবিদ, বন্ধুপ্রতীম দেশসমূহের সামরিক উপদেষ্টাগণ, বুদ্ধিজীবি এবং গণমাধ্যম ব্যক্তিবর্গসহ স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের নিরাপত্তা এবং কৌশলগত পরিবেশ দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। অপ্রতিসম হুমকির উত্থান, রাষ্ট্রবিরোধী সদস্য ও সংগঠনের উপস্থিতি, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিঘিœত পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক প্রভাব, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং তথ্য যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা পরিস্থিতিকে বহুগুণে জটিল করে তুলেছে। ফলশ্রুতিতে শান্তিরক্ষীরা নিজেরাও নানা প্রকার আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। এছাড়াও বিশ্বজুড়ে নারী ও শিশুরা ক্রমাগত বহুমুখী হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। তাই এ জাতীয় সংঘাত প্রতিরোধ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় নারীদের ভূমিকা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে শান্তিরক্ষা কন্টিনজেন্ট সমূহের সাংগঠনিক কাঠামো ও কার্যপদ্ধতির পরিবর্তন জরুরি বলে সেমিনারে উপস্থিত বক্তাগণ মনে করেন।
এছাড়াও সেমিনারের পূর্বে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ, এসবিপি, ওএসপি, এনডিইউ, পিএসসি, পিএইচডি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মরত জেসিও/ওআরগণের জন্য ঢাকা সেনানিবাসের মোস্তফা কামাল লাইন এলাকায় বহুতল ভবন ‘শান্তিরক্ষী নিবাস’ নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এ ভবন নির্মিত হলে জাতিসংঘে মোতায়েন শান্তিরক্ষীদের পরিবারের আবাসন পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।