ঢাকা, ২৮ অক্টোবর ঃ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা, জাতির গর্বিত কৃতি সন্তান এবং কিলোফ্লাইটের বৈমানিক স্কোয়াড্রন লীডার বদরুল আলম, বীর উত্তম (অবঃ) ২৭ অক্টোবর ২০২৩, শুক্রবার বেলা ১ টা ৩০ ঘটিকায় ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তিনি স্ত্রী নাদিরা আলম, এক কন্যা, এক পুত্র ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ঘাঁটি বাশার প্যারেড গ্রাউন্ড-এ ২৮ অক্টোবর ২০২৩, শনিবার মরহুমের নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয় এবং গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। মহামান্য রাষ্ট্রপতির পক্ষে ভারপ্রাপ্ত সহকারী সামরিক সচিব লেফটেন্যান্ট কর্ণেল সৈয়দ মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, পিএসসি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সহকারী সামরিক সচিব কর্ণেল জি.এম. রাজীব আহমেদ, পিএসসি এবং সম্মানিত বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল শেখ আব্দুল হান্নান, বিবিপি, বিইউপি, এনএসডব্লিউসি, এফএডব্লিউসি, পিএসসি মরহুমের কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন। এছাড়াও অনুষ্ঠানে স্কোয়াড্রন লীডার বদরুল আলম, বীর উত্তম (অবঃ) এর পরিবারের সদস্যগণ, সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ এবং অন্যান্য পদবীর সদস্যবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। ফিউনারেল প্যারেড শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্কোয়াড্রন লীডার বদরুল আলম, বীর উত্তম (অবঃ)-কে বিমান বাহিনী ঘাঁটি বাশার এ অবস্থিত শাহীন কবরস্থানে দাফন করা হয়। বীরমুক্তিযোদ্ধার সম্মানার্থে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী কর্তৃক বিভিন্ন বিমানের ফ্লাই পাস্ট অনুষ্ঠিত হয়।
স্কোয়াড্রন লীডার বদরুল আলম, বীর উত্তম (অবঃ) ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ তারিখে ঢাকা জেলায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম খন্দকার মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা এবং মাতার নাম মিসেস হোসনে আরা বেগম। তিনি ১৯৬৫ সালে পিএএফ পাবলিক স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৬৮ সালে পিএএফ একাডেমী, রিসালপুর, পাকিস্তান থেকে এফএসসি পাশ করেন।
স্কোয়াড্রন লীডার বদরুল আলম, বীর উত্তম (অবঃ) ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ তারিখে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগদান করেন। একাডেমীতে সাফল্যের সাথে প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর ২৮ জানুয়ারি ১৯৬৮ তারিখে জিডি (পি) শাখায় পাইলট অফিসার পদবীতে কমিশন লাভ করেন। স্কোয়াড্রন লীডার বদরুল আলম ছিলেন একজন চৌকস বৈমানিক। চাকরিকালীন তিনি তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া হতে এমআই-৮ হেলিকপ্টার ও মিগ-১৯ বিমান চালনা প্রশিক্ষণ কোর্স সহ দেশে বিদেশে বিভিন্ন পেশাগত কোর্সে অংশগ্রহণ করেন এবং সফলতার সাথে তা সম্পন্ন করেন।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় তিনি বিমান ঘাঁটি ঢাকায় হেলিকপ্টার স্কোয়াড্রনে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭১ এর মে মাসে পিএএফ ঘাঁটি ত্যাগ করার পর ১৯৭১ এর সেপ্টেম্বর মাসে ‘কিলো ফ্লাইট’ গঠন হবার পূর্ব পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ ফোর্সেস, সদর দপ্তরে স্টাফ অফিসার হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
তৎকালীন স্কোয়াড্রন লীডার (পরবর্তীতে এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ, বীর উত্তম) এর কো-পাইলট হিসেবে স্কোয়াড্রন লীডার বদরুল আলম বাঙ্গালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহবানে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে সর্ব প্রথম বিমান অভিযান পরিচালনা করেন। ১৯৭১ এর ৩রা ডিসেম্বর মাঝ রাত্রিতে তাঁরা তেলিয়ামুরা থেকে তাঁদের এ্যালুয়েট-৩ হেলিকপ্টার নিয়ে উড্ডয়ন করেন এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। শত্রুর সজাগ দৃষ্টি উপেক্ষা করে নারায়নগঞ্জের সন্নিকটে গোদনাইলের জ্বালানী ডিপোতে আঘাত হেনে মারাত্মক ক্ষতি সাধন করেন। ঢাকায় পাকিস্তানীদের শক্তিশালী অবস্থানে দুঃসাহসিক আঘাত হেনে শত্রুদের জ¦ালানী ডিপোটির ধ্বংস সাধন করে নিরাপদে প্রত্যাবর্তন করেন।
স্কোয়াড্রন লীডার বদরুল আলম, বীর উত্তম ১৯৭১ এর ৩ থেকে ১৫ই ডিসেম্বরের মধ্যে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে অনেকগুলো সফল অভিযান পরিচালনা করেন। বিভিন্ন সময় তিনি এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ, বীর উত্তম এবং ক্যাপ্টেন সাহাব উদ্দিন, বীর উত্তম এর কো-পাইলট হিসেবে সিলেট, কুলাউড়া, নরসিংদী, কুমিল্লা এবং দাউদকান্দি সেক্টর সমূহে অসংখ্য বিমান অভিযানের মাধ্যমে পাকিস্তানীদের মনে দারুন ভীতির সঞ্চার করেছিল। সেসময় তিনি মোট ১৬ টি সফল অভিযান পরিচালনা করেন। এধরনের অসংখ্য বিমান অভিযানের ফলে অল্প দিনের মধ্যেই পাকিস্তানিদের মনোবল দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তাদের ভাগ্যে চুড়ান্ত পরাজয় সূচিত হয়েছিল। এই সফল অভিযানগুলো মুক্তিযুদ্ধের আকাশ জয়ের গল্প এবং সামরিক ইতিহাসের বিরল ঘটনা।
চাকরিকালীন তিনি টি-৩৭বিসি, টি-৩৩এ, এফ-৮৬এফ, ইউ-মিগ-১৫, মিগ-১৯সি, এইচ এইচ-৪৩বি, এইচ-১৯ডি, এ্যালুয়েট-৩, মিগ-৮ এবং ডব্লিউএক্স এমকে-৫ এয়ারক্রাফট উড্ডয়ন করেন। তিনি ০৭ বছর ১০ মাস ১৩ দিন চাকরি সমাপনান্তে ২৬ মার্চ ১৯৮০ তারিখে স্কোয়াড্রন লীডার পদবীতে অবসর গ্রহণ করেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে অসমসাহসিক অবদানের প্রেক্ষিতে স্কোয়াড্রন লীডার বদরুল আলমকে ‘বীর উত্তম’ উপাধিতে ভুষিত করা হয়। এছাড়াও তিনি মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘স্বাধীনতা পুরস্কার-২০১৬’-এ ভূষিত হন।