ঢাকা, ১২ জুলাই ২০১৯ : জাতিসংঘ সদরদপ্তরে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে শান্তিরক্ষী সরবরাহকারী দেশসমুহের (Troops Contributing Countries) ‘সামরিক বাহিনী প্রধানগণের সম্মেলন (Chiefs of Defence Conference)’ এর স্বাগত অনুষ্ঠান বুধবার (১০-৭-২০১৯) আয়োজন করে বাংলাদেশ। এছাড়া, একই দিন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ত্রি-পক্ষীয় সহযোগিতা শক্তিশালীকরণ (Strengthening Triangular Cooperation for Peacekeeping Operations) বিষয়ক এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বিশেষ আমন্ত্রণে বক্তব্য রাখেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন।
শান্তিরক্ষী কার্যক্রমে সামনের সারির একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবদান ও সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতার কারণে মর্যাদাপূর্ণ এই অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য জাতিসংঘ সদরদপ্তর বাংলাদেশকে মনোনীত করে। কালজয়ী বাংলা গান ও বাঙালি খাবারে অতিথিদের আপ্যায়নের মাধ্যমে অনুষ্ঠানটিতে আবহমান বাংলাদেশের সংস্কৃতি তুলে ধরা হয়।
সামরিক বাহিনী প্রধানগণের সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল ড. মাহফুজুর রহমান, জাতিসংঘের পিস অপারেশন বিভাগের প্রধান আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জ্যঁ পিয়েরে ল্যাক্রুয়া (Jean-Pierre Lacroix), জাতিসংঘের অপারেশনাল সাপোর্ট বিভাগের প্রধান আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল অতুল খারে (অঃঁষ কযধৎব) এবং জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের মিলিটারি অ্যাডভাইজর লেফটেন্যান্ট জেনারেল কার্লোস হামবার্টো লয়টে (Carlos Humberto Loitey)।
অনুষ্ঠানে জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশকে সম্মানজনক এই অনুষ্ঠান আয়োজনের সুযোগ দেওয়ায় জাতিসংঘকে ধন্যবাদ জানান। তিনি আরোও বলেন তিনদশকেরও বেশী সময় ধরে জাতিসংঘের ব্লু হেলমেট এর অধীনে বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় সুনিপুণভাবে বাংলাদেশ দায়িত্ব পালন ও তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখে চলছে। পাশাপাশি ধারাবাহিকভাবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। তিনি বলেন বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃঢ় প্রতিশ্রুতি ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের ফলে এসব সম্ভব হয়েছে। শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের বহুমূখী চ্যালেঞ্জসমুহের কথা উল্লেখ করেন এবং এসকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীগণ সদা প্রস্তুত রয়েছে মর্মে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তিনি অবহিত করেন।
উক্ত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর পক্ষে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল ড. মাহফুজুর রহমান তাঁর বক্তব্যে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের যে প্রতিজ্ঞা ও প্রতিশ্রুতি রয়েছে তা এসেছে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থেকে। বাংলাদেশ সর্বদাই এ প্রতিজ্ঞায় অবিচল থাকবে। তিনি আরোও বলেন এই সম্মেলন তথ্য ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের অন্যতম প্লাটফর্ম হিসেবে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সম্মিলিত সামর্থ্য বৃদ্ধিতে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখবে।
জাতিসংঘের পিস অপারেশন বিভাগের প্রধান আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জ্যঁ পিয়েরে ল্যাক্রুয়া (Jean-Pierre Lacroix) তাঁর বক্তব্যে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ সুদীর্ঘ ৩০ বছরেরও বেশিসময় ধরে গৌবরের সাথে অবদান রেখে চলছে। শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সেরা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জাতিসংঘ মহাসচিবের অ্যাকশন ফর পিস কিপিং এজেন্ডায় বাংলাদেশের সক্রিয় ভূমিকারও তিনি ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, এমন একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের এই সফলতা বাংলাদেশের সক্ষমতারই বহি:প্রকাশ। এ সম্মেলন জাতিসংঘ মহাসচিবের অ্যাকশন অব পিস কিপিং এজেন্ডাকে আরও এগিয়ে নিতে এবং শান্তিরক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সম্মিলিত প্রয়াস গ্রহণে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে তিনি মনে করেন।
জাতিসংঘের অপারেশনাল সাপোর্ট বিভাগের প্রধান আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল অতুল খারে (অঃঁষ কযধৎব) তাঁর বক্তব্যে এমন চমৎকার আয়োজনের জন্য বাংলাদেশকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। জাতিসংঘের নীল হেলমেটের অধীনে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অবদান ও আত্মোৎসর্গের প্রতি তিনি বিনম্্র শ্রদ্ধা জানান। তিনি কর্তব্যরত অবস্থায় নিহত সদস্যদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। তিনি বিশ্বকে আরও শান্তির্পূণ করতে বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের প্রজ্ঞা, অংশীদারিত্ব, সমর্থন ও সহযোগিতার ভূয়সী প্রশংসা করেন।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের মিলিটারি অ্যাডভাইজর লেফটেন্যান্ট জেনারেল কার্লোস হামবার্টো লয়টে (ঈধৎষড়ং ঐঁসনবৎঃড় খড়রঃবু) তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য শান্তিরক্ষী হিসেবে অভিহিত করেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী মিলিয়ে ৬৪ জন সামরিক প্রধান এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এছাড়া সদস্য দেশসমুহের উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা, স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূতগণ এবং জাতিসংঘের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ প্রায় চারশত অতিথি এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। অন্যান্যদের মাঝে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মিশনের মিলিটারি অ্যাডভাইজর ব্রিগেডিয়ার খান ফিরোজ আহমেদ ও বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল নিউইয়র্ক এর কনসাল জেনারেল মিজ্ সাদিয়া ফয়জুন্নেছা।
অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন বাংলাদেশ মিশনের মিলিটারি অ্যাডভাইজর ব্রিগেডিয়ার খান ফিরোজ আহমেদের কন্যা ফাবিহা তাহসিন। উল্লেখ্য সামরিক বাহিনী প্রধানগণের দু’দিন ব্যাপী এই সম্মেলন ১১ জুলাই শেষ হয়েছে।
এছাড়া একই দিন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ত্রি-পক্ষীয় সহযোগিতা শক্তিশালীকরণ (Strengthening Triangular Cooperation for Peacekeeping Operations) বিষয়ক এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বিশেষ আমন্ত্রণে বক্তব্য রাখেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন।
তিনি তাঁর বক্তব্যে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের সূদীর্ঘ অভিজ্ঞতা, দায়িত্বশীলতা, পেশাগত দক্ষতা ও অব্যাহত সাফল্যের কারণে ত্রি-পক্ষীয় সহযোগিতা শক্তিশালীকরণ বিষয়ক এই আলোচনা অনুষ্ঠানে বিশেষ বক্তব্য রাখার জন্য বাংলাদেশকে নির্ধারণ করা হয় বলে জানান। তিনি নিরাপত্তা পরিষদ, সামরিক ও পুলিশ শান্তিরক্ষী সরবরাহকারী দেশ এবং জাতিসংঘ সচিবালয়ের মধ্যে ত্রি-পক্ষীয় সহযোগিতার ক্ষেত্রে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে: ত্রি-পক্ষীয় সহযোগিতার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নার্থে ‘ক্রিসমাস ট্রি ম্যানডেট’ এর মতো উভয় সঙ্কট অতিক্রম করা; শান্তিরক্ষা বিষয়ক আলোচনার বিশেষ প্লাটফর্ম সি-৩৪ (ঈ-৩৪), সাধারণ পরিষদের বাজেট সংক্রান্ত কমিটি, নিরাপত্তা পরিষদের ওয়ার্কিং গ্রুপ, সামরিক ও পুলিশ শান্তিরক্ষী সরবরাহকারী দেশ এবং জাতিসংঘ সচিবালয়সহ এ সংক্রান্ত প্রতিটি প্লাটফর্মের আন্তসমন্বয়, পারস্পরিক বোঝাপড়া ও আন্ত:আলোচনা জোরদার করা; এসকল ক্ষেত্রে আভ্যন্তরীন বাধাসমূহ দূর করা; ত্রি-পক্ষীয় সহযোগিতাকে আরও ফলপ্রসূ ও সুগঠিত করতে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সভার আয়োজন করা এবং নিরাপত্তা পরিষদের ওয়ার্কিং গ্রুপকে অনুঘটকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার মতো সুপারিশসমূহ।
নিরাপত্তা পরিষদের চলতি জুলাই মাসের সভাপতি পেরু এই আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।